প্রভাতী ডেস্ক : কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে জমা দিয়েছে র্যাব। এতে টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রবিবার (১৩ই ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আলোচিত মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে চার্জশিট জমা দেন। পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম সাংবাদিকদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
চার্জশিটে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৩০২ ধারার অপরাধে এই অভিযোগপত্র দেয়া হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন ইতিমধ্যে কারাগারে আছেন। বাকি একজন পলাতক।
কারাগারে থাকা অভিযুক্ত ১৪ আসামি হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন এবং আয়াজ উদ্দিন।
গত ৩১শে জুলাই টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করা এই ঘটনায় তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফের বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেন। টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ মোট ৯জন পুলিশ সদস্যকে এই মামলায় আসামি করা হয়। বিচারক তামান্না ফারাহ মামলাটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন এবং মামলার তদন্তভার দেয়া হয় র্যাবকে।
আদালতের নির্দেশে সিনহার বোনের করা মামলার তদন্ত করে র্যাব। এছাড়া এই ঘটনার তদন্তে গত ১লা আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ৬৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রশাসনিক ওই তদন্তে কক্সবাজারে চেকপোস্টে পুলিশের ভূমিকা অপেশাদার ও হটকারী বলে মন্তব্য করা হয়। ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বেশকিছু সুপারিশ করেন তারা। প্রশাসনিক ওই তদন্তের পর এখন ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় চার্জশিট দাখিল হলো।
রবিবার বিকালে ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই তদন্তের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন এই বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
তিনি বলেন, “এ মামলার তদন্তের মূল বিষয় হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সাবেক ওসি প্রদীপের স্বেচ্ছাচারিতা ও ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি সিনহা জেনে যাওয়ায় এই ঘটনা।”
গত ৩১শে জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
কিন্তু পুলিশের দেওয়া ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত শুরু করে। পরিদর্শক লিয়াকত ও ওসি প্রদীপসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
সিনহা হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে প্রদীপের অবৈধ কর্মকাণ্ডের কোনো বিষয় থাকতে পারে, সে গুঞ্জন তখন থেকেই ছিল। কিন্তু তদন্তকারীদের তরফ থেকে এর আগে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজেই তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
সিনহার বোনের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, সিনহা ও সিফাত ৩১ জুলাই বিকালে ডকুমেন্টারির জন্য ভিডিও ধারণ করতে নীলিমা রিসোর্ট থেকে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রাস্তার পাশের পাহাড়ে যান। ফেরার পথে রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে সিনহার প্রাইভেট কার শামলাপুর চেক পোস্টে আটকান পরিদর্শক লিয়াকতসহ পুলিশ সদস্যরা।
সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত উপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিলেও পরিদর্শক লিয়াকত তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। এরপর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন করে নিচুস্বরে সলাপরামর্শ করেন। এক পর্যায়ে লিয়াকত ফোনে প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি’।
“ওই সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরিদর্শক লিয়াকত সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের শরীরের উর্ধ্বাংশে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান এবং নিজের জীবন রক্ষার জন্য ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। লিয়াকত আলি তখন সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরো এক রাউন্ড গুলি করেন।”
এজাহারে বলা হয়, “এর পরপর ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে ওসি প্রদীপ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং নিজের বুট জুতা দিয়ে ঘষা দিয়ে নিহতের মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন।”
রাত পৌনে ১২টার দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে উল্লেখ করা হয় মামলায়।
ওই ঘটনা ‘পরিকল্পিত’ ছিল মন্তব্য করে র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি জেনে যাওয়ায় সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল।
“প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে এমনটিই পেয়েছেন।”
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার প্রশংসা করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, “পুলিশে ৩২ বছর ধরে কাজের অভিজ্ঞতা ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও প্রভাবমুক্ত হয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।”
৪ মাস ১০ দিন ধরে তদন্ত শেষে ২৬ পৃষ্ঠার যে তদন্ত প্রতিবেদন খায়রুল ইসলাম আদালতে দিয়েছেন, তাতে মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহা হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনায়’ ছিলেন বরখাস্ত ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত, এসআই নন্দদুলাল, তিন এপিবিএন সদস্য এবং বেসামরিক তিনজন, যাদের পুলিশের মামলায় সাক্ষী করা হয়েছিল।
এছাড়া এসআই লিটনসহ অন্যরা ‘ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার’ চেষ্টা করেছেন বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
আশিক বিল্লাহ বলেন “জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লিয়াকত তিন সোর্স নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজের সঙ্গে হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে সাক্ষাতও করেছিলেন, সে তথ্যও তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পেরেছেন।”
এছাড়া গুলি করার পর সিনহার ‘মৃত্যু নিশ্চিত’ করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে ‘সময়ক্ষেপণ’ করা হয় এবং পরে ‘লোক দেখাতে’ হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেন এই র্যাব কর্মকর্তা।
এক প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহা ছিলেন সদালাপী, মানুষের সঙ্গে দ্রুত মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। ‘ভিডিও কন্টেন্ট’ তৈরি করতে কক্সবাজারে গেলেও এলাকাবাসীর কাছ থেকে কথায় কথায় তিনি প্রদীপের ‘অপকর্মের খবর’ জেনে যান এবং প্রদীপের কাছে বিষয়টি জানতে চান।
সে সময় প্রদীপ কি হুমকি দিয়েছিলেন- এ প্রশ্নে র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, “কক্সবাজার থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল এবং না গেলে সিনহাকে ধ্বংস করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল প্রদীপ।”
তবে সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর তাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ যা যা পুলিশ জব্দ করেছিল, সেগুলো র্যাবের হাতে যাওয়ার পর তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি বলে জানান আশিক বিল্লাহ। তার ধারণা, ডিজিটাল কনটেন্ট যা ছিল, তা ‘আগেই ধ্বংস করা হয়েছে’।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রদীপ সরকারি বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে কক্সবাজারে অভয়ারণ্য তৈরি করেছিল।”
প্রদীপের অপরাধের সঙ্গে তখনকার পুলিশ সুপারের কোনো সংশ্লিষ্টতার তথ্য তদন্তে এসেছে কি না জানতে চাইলে আশিক বিল্লাহ বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপারের ‘উদাসীনতা ও অপেশাদার আচরণের’ প্রমাণ পেয়েছেন। তাই প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।